ঢাকা , বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫ , ১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ |

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাই-তন্ত্র, ব্যক্তি পূজা ও পারিবারিক আধিপত্যবাদের অবসান কি সম্ভব?

আপলোড সময় : ১৬-০৭-২০২৫ ০৪:৪৯:৫২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ১৬-০৭-২০২৫ ০৪:৪৯:৫২ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাই-তন্ত্র, ব্যক্তি পূজা ও পারিবারিক আধিপত্যবাদের অবসান কি সম্ভব?
লেখক/ লন্ডন থেকে- নাজিম রুবেল (কলামিস্ট ও সমাজকর্মী) বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মুখোমুখি। এই সংকট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক বা নীতিগত নয়—এটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সংকটও বটে। রাজনীতিতে ভাই-তন্ত্র, ব্যক্তি পূজা, ও পারিবারিক আধিপত্য—এই তিনটি উপাদান একধরনের গোপন অথচ গভীর একনায়কত্ব তৈরি করছে, যা গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনার পরিপন্থী। ভাই-তন্ত্র: দল নয়, পরিবারই দল বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলে “ভাই-তন্ত্র” এখন এক চর্চিত বাস্তবতা। একজন নেতা নির্বাচিত বা ক্ষমতাশালী হলেই দেখা যায়, তার ভাই, ভগ্নিপতি, ভাগ্নে কিংবা ছেলে-মেয়ে দল বা সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন। এতে দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীরা উপেক্ষিত হন, তৃণমূল হতাশ হয়ে পড়ে। ভাই-তন্ত্র ধীরে ধীরে দলকে পরিবারে রূপান্তর করে—যেখানে পদে আসীন হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা রক্তের সম্পর্ক। উদাহরণ: • বিভিন্ন সংসদীয় আসনে দেখা গেছে, প্রয়াত নেতার ভাই বা পুত্রই তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনয়ন পান। • সরকারি ও দলীয় প্রকল্প বা পদে ভাই-ভগ্নিপতির অনুপ্রবেশ নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি পূজা: আদর্শের নয়, মুখের রাজনীতি রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজা নতুন নয়, তবে এখন তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রাজনীতিকরা দলীয় আদর্শ নয়, বরং ব্যক্তিকে ঈশ্বরের মতো উপস্থাপন করেন। কেউ কেউ দলের চেয়ে বড় হয়ে যান। ফলে: • সমালোচনাকে ‘অবিশ্বাস’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় • ব্যক্তি ভুল করলেও তা সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকে না • কর্মীরা নেতা নয়, দেবতা তৈরি করে—যা গণতন্ত্রে বিরাট অন্তরায় পরিণতি: দলের ভেতর থেকে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না। যারা প্রশ্ন তোলে, তারা “বিশ্বাসঘাতক” হিসেবে চিহ্নিত হয়। পারিবারিক আধিপত্য: রাজনীতি নয়, উত্তরাধিকার বাংলাদেশে রাজনীতি দিন দিন একটি পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই পরিবারকেন্দ্রিক। এতে রাজনীতিকে একটি “পারিবারিক ব্র্যান্ড” হিসেবে দেখা হয়। রাজনীতিকরা জনগণের ভোটে নয়, পিতার/মায়ের/ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচয়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। এর প্রভাব: • রাজনীতির পেশাদারিত্ব বিলুপ্ত হয় • নীতি নির্ধারণ হয় পারিবারিক বৈঠকে, দলীয় ফোরামে নয় • গণতন্ত্র থেকে উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতন্ত্রে রূপান্তর ঘটে। এই প্রবণতা কেন টিকে আছে? ১. গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব: দলগুলোতে নির্বাচন বা মতপ্রকাশের সুযোগ নেই ২. নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা: নেতৃত্ব জনগণের চেয়ে পারিবারিক অনুমোদনেই নির্ধারিত ৩. মিডিয়ার একচোখা ভূমিকা: সমালোচনার জায়গা সংকুচিত ৪. জনগণের নিষ্ক্রিয়তা: “সবাই তো এক” ধরনের মানসিকতা থেকে প্রশ্নহীন গ্রহণযোগ্যতা। তবে কি কোনো আশার আলো নেই? আছে, যদি নীচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যায়: • দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক নির্বাচন চালু করতে হবে—পদ, মনোনয়ন বা দায়িত্ব যেন পারিবারিক নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় • যুব সমাজকে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে—যারা ব্যক্তি নয়, আদর্শকে প্রাধান্য দেয় • সচেতন নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে—মিডিয়া, একাডেমিয়া ও নাগরিক সংগঠনের চাপ তৈরি করতে হবে • সংবিধান ও আইনের সংস্কার প্রয়োজন—যাতে স্বজনপ্রীতি নিরুৎসাহিত হয় শেষ কথা: ভাই-তন্ত্র, ব্যক্তি পূজা এবং পারিবারিক আধিপত্য ও চাটুকারিতা এই ক্যান্সার গণতন্ত্রের শরীরে বাসা বেঁধেছে। এগুলো নির্মূল না করা গেলে রাজনীতি আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না, বরং তা হবে একটি রক্তবংশীয় ক্ষমতার খেলা। তবে ইতিহাস বলে, নির্বাচনের চেয়ে জোরালো শক্তি হচ্ছে জনগণের বিবেক। সুতরাং পরিবর্তন সম্ভব—শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, আমাদের সম্মিলিত সচেতনতা ও প্রতিরোধই পারে রাজনীতিকে মুক্ত করতে ।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SM Sohel

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ